ফাস্ট ফুড এবং ফাস্টফুডের অপকারিতা

 

ফাস্ট ফুড এবং ফাস্টফুডের অপকারিতা

বেঁচে থাকার জন্য আমাদের সবারই খাবার গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তবে দিন দিন সহজলভ্য হয়ে ওঠা বিভিন্ন জাঙ্ক বা ফাস্ট ফুড আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এসব খাবারের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জানা এবং সেগুলো থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, উনবিংশ শতাব্দীর আগেও আমাদের বেশিরভাগ খাবারই ঘরেই তৈরি হতো। কাঁচামাল নিজেরা উৎপাদন করতাম এবং সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করা হতো ঘরের পরিবেশেই। ফলে সেই খাবারে প্রাকৃতিক উপাদানের সুরক্ষা বজায় থাকত। কিন্তু আধুনিক যুগে রাস্তার পাশের জাঙ্ক ফুডের সহজলভ্যতা আমাদের খাদ্যাভ্যাসে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। নিয়মিত জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ফাস্ট ফুড এবং ফাস্টফুডের অপকারিতা

তাই, নিজের সুস্থতার কথা বিবেচনা করে আমাদের উচিত জাঙ্ক ফুডের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এসব খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা। আসুন, আমরা জেনে নিই এই সব অস্বাস্থ্যকর খাবারের ক্ষতিকর দিকগুলো এবং সচেতনভাবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলি।

 আরো পড়ুনঃত্বকের অ্যালার্জি | কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানেন কি?

ফাস্ট ফুড কী?

ফাস্ট ফুড হলো এমন একধরনের খাবার, যা বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি। এসব খাবার নিয়মিত গ্রহণের ফলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, এমনকি মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফাস্ট ফুডে অতিরিক্ত পরিমাণে চর্বি, লবণ এবং কার্বনেট জাতীয় উপাদান থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

এইসব উপাদান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করে। তাই, শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ফাস্ট ফুড থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি।

ফাস্ট ফুডে ক্ষতিকর কী কী থাকে?

ফাস্ট ফুডে এমন অনেক অস্বাস্থ্যকর উপাদান থাকে, যা আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। নিচে এসব উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১। গোপন বা লুক্কায়িত চিনি: 

অনেক জাঙ্ক বা ফাস্ট ফুডে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত চিনি ব্যবহার করা হলেও সেগুলো সরাসরি "চিনি" নামে উল্লেখ করা হয় না। তবে এই উপাদানগুলো খাবার হজমের সময় চিনিতে পরিণত হয়। যেমন কর্ন সিরাপ, ফ্রুক্টোজ, সুক্রালোজ ইত্যাদি উপাদান খাবারের ক্যালোরি বাড়িয়ে শরীরের ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ ধরনের লুকায়িত চিনি নিয়মিত গ্রহণ করলে স্থূলতা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।

ফাস্ট ফুড এবং ফাস্টফুডের অপকারিতা

২। কৃত্রিম বা বিকল্প চিনি:

অনেক ফাস্ট ফুডে কৃত্রিম চিনি ব্যবহারের ফলে শরীরে স্বাভাবিকের তুলনায় চিনির মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে সুক্রালোজ, এসিসালফেইম পটাশিয়াম এবং স্যাকারিনের মতো উপাদান চিনি বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও এ উপাদানগুলোতে ক্যালরির পরিমাণ কম, তবুও এগুলো বিপাক প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায় এবং শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে সমস্যা সৃষ্টি করে।

৩। হাইড্রোজেনেট তেল: 

ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবার তৈরির জন্য প্রায়ই হাইড্রোজেনযুক্ত তেল ব্যবহার করা হয়। এই হাইড্রোজেনেটেড তেল শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। বাণিজ্যিকভাবে প্যাকেজকৃত খাবার, বিশেষ করে চিপস ও ক্র্যাকার, সাধারণত এই তেল দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।

ফাস্ট ফুড এবং ফাস্টফুডের অপকারিতাতাই এ ধরনের খাবার পরিত্যাগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এসব বাহিরের অস্বাস্থ্যকর খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন, কারণ তাদের স্বাস্থ্যের ওপর এই খাবারগুলো মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ফাস্ট ফুডের ক্ষতিকর দিকসমুহঃ

১।রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ও বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াঃ

ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এসব খাবার সাধারণত রাস্তার ধারে বিক্রি হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে খাবার উপযোগী রাখার চেষ্টা করা হয়, যা জীবাণুর বিস্তারের সুযোগ বাড়ায়। এই জীবাণু মিশ্রিত খাবার শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পারে।

তদুপরি, এসব খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল করে দেয়। তাই রাস্তার ধারের বিভিন্ন জাঙ্ক ফুড খাওয়া এড়িয়ে চলা এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সুস্থ জীবনযাপনের জন্য একটি বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত।

২।ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধিঃ

ফাস্ট ফুড মূলত বাসি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব খাবার নিয়মিত খেলে ত্বকের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন ত্বকের সতেজতা হারিয়ে যাওয়া। চর্বি জাতীয় খাবার অতিরিক্ত গ্রহণের ফলে মুখ শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়।

এছাড়া ত্বকের অন্যান্য সমস্যার মধ্যে ব্রণ, এলার্জি, এবং ত্বকের প্রদাহ সাধারণভাবে দেখা দেয়। তাই ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখতে ফাস্ট ফুড থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি।

৩। দেহের ওজন বেড়ে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াঃ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪০ বছরে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা প্রায় দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মিত জাঙ্ক ফুড গ্রহণের ফলে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এবং স্থূলতার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।

বিশ্বজুড়ে মোটা হওয়ার প্রবণতা ফাস্ট ফুড খাওয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এসব খাবার রক্তে চিনির মাত্রা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত রক্তের চিনির ওঠানামার কারণে অগ্নাশয়ের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, যা ইনসুলিন নিঃসরণের পরিমাণও কমিয়ে দেয়। এর ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্নায়ুর ক্ষতি, কিডনির সমস্যা এবং আলঝেইমারের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

Institute for Health Metrics and Evaluation-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ এবং শিশুদের মধ্যে ৪.৫ শতাংশ মানুষ স্থূলকায়। ফাস্ট ফুডে অতিরিক্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট এবং চর্বি থাকায় তা শরীরে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে মেদ বৃদ্ধি করে। অতিরিক্ত চর্বি শরীরে জমে যাওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধি পায়, যা শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায় এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

ফাস্ট ফুড এবং ফাস্টফুডের অপকারিতা

আজকের ব্যস্ত জীবনযাত্রায় অনেকেই খাবার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সময় বের করতে পারেন না। এ সুযোগে জাঙ্ক ফুড কোম্পানিগুলো আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। প্রতিনিয়ত তারা "একটি কিনলে একটি ফ্রি" বা খাবারের ওপর বিশেষ ছাড়ের মতো বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। ফেসবুকের প্রমোশনাল পোস্টে ডিসকাউন্টের প্রলোভন আমাদের ফাস্ট ফুডের প্রতি আরও ঝুঁকিয়ে দিচ্ছে।

জাঙ্ক ফুড যে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে নিজের ভালো চিন্তা করে হলেও আমাদের স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আগ্রহী হওয়া উচিত। যতই ডায়েটিং বা ব্যায়াম করা হোক, জাঙ্ক ফুড খাওয়ার কারণে ওজন কমাতে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

তাই আসুন, আমাদের খাদ্যাভ্যাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি। যতটা সম্ভব ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করি এবং জাঙ্ক ফুড থেকে দূরে থাকি। এটি কেবল আমাদের শরীরের সুস্থতা নয়, জীবনের মানও উন্নত করবে।

আরো পড়ুনঃরসুন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

উপসংহার

ফাস্টফুড নিয়মিত গ্রহণের কারণে আরেকটি বড় ক্ষতি হলো, রক্তনালীতে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রমে সমস্যা হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রেও, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা শারীরিক নড়াচড়ায় সক্রিয় হতে পারে না। কখনো কখনো, শিশুদের প্রতি অতিরিক্ত ভালবাসা বা ইমোশনাল অত্যাচারের কারণে আমরা বাধ্য হয়ে তাদের হাতে অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড তুলে দেই।

কিছু ক্ষেত্রে, অজ্ঞতার কারণে, বাবা-মা অস্বাস্থ্যকর এসব খাবার শিশুর হাতে তুলে দেন। যে কারণেই হোক, এর ফলাফল কিন্তু উদ্বেগজনক। সুষম খাবারই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক। নিয়মিত শাকসবজি ও ফলমূল খেলে শিশুর যে পুষ্টি লাভ হয়, তাতে শুধু মেধার বিকাশই নয়, বরং সুস্থ এবং সক্ষম একটি মানুষ হিসেবে তাদের বেড়ে ওঠা নিশ্চিত হয়।

Comments

Popular posts from this blog

বিউটিফুল স্পট কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত(Beautiful spot Cox's Bazar beach)

কফির বীজ সংরক্ষণের উপায়

আমড়া খাওয়ার উপকারিতা