বিউটিফুল স্পট কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত(Beautiful spot Cox's Bazar beach)
বিউটিফুল স্পট কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত(Beautiful spot Cox's Bazar beach)
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত একটি মনোরম প্রাকৃতিক সৈকত। ১২০ কিলোমিটার (৭৫ মাইল) দৈর্ঘ্যের এই সৈকত বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত হিসেবে পরিচিত।

ভূমিকা
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অখণ্ডিত সমুদ্র সৈকত হিসেবে পরিচিত। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, পুরো সৈকতটি বালুকাময়, যেখানে কাদার কোনো চিহ্ন নেই। বালিয়াড়ির পাশে রয়েছে শামুক, ঝিনুকসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল সমৃদ্ধ বিপণি বিতান। পাশাপাশি, অত্যাধুনিক হোটেল-মোটেল-কটেজ এবং বার্মিজ মার্কেটগুলো নিত্য নতুন সাজে সজ্জিত থাকে, যা পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।
এই সমুদ্র সৈকত তার মায়াবী ও রূপময়ী সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। প্রতিদিন ও প্রতিক্ষণ এর রূপ পরিবর্তন করে, যা ঋতু অনুযায়ী নয় বরং সময়ের প্রবাহে ভিন্নতা সৃষ্টি করে। প্রত্যুষের এক রকম সৌন্দর্য মধ্যাহ্নে অন্য রকম হয়ে ওঠে। শীত, বর্ষা, বসন্ত কিংবা গ্রীষ্ম—সব ঋতুতেই এর অনন্য সৌন্দর্য অপরিবর্তিত থাকে।
প্রতিদিন অসংখ্য দেশি ও বিদেশি পর্যটক এই সমুদ্র সৈকতের অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসেন, যা কক্সবাজার শহরের পর্যটন মৌসুমে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।
ভূগোল
কক্সবাজার সৈকত গড়ে ভরা জোয়ারের সময় প্রায় ২০০ মিটার (৬৬০ ফুট) এবং নিম্ন জোয়ারের সময় প্রায় ৪০০ মিটার (১,৩০০ ফুট) প্রশস্ত হয়। তবে ভাটার সময়ে চোরাবালি জেগে ওঠে, যা সৈকতকে বিপদজনক করে তোলে।
ইতিহাস
নবম শতাব্দীর শুরু থেকে ১৬১৬ সালে মুঘলদের দখল নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের একটি বৃহৎ অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অধীন ছিল। মুঘল সম্রাট শাহ সুজা পাহাড়ি পথ ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন এবং এখানে ক্যাম্প স্থাপনের নির্দেশ দেন। তার যাত্রাবহরে থাকা প্রায় এক হাজার পালঙ্কি কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা নামক স্থানে অবস্থান নেয়। "ডুলাহাজারা" শব্দের অর্থই হলো "হাজার পালঙ্কি।"
মুঘল শাসনের পর এই এলাকা ত্রিপুরা, আরাকান, পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কক্সবাজারের নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নামানুসারে। আগে এই অঞ্চলের নাম ছিল পালংকি। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর হিরাম কক্সকে পালংকির মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হয়। তিনি আরাকান থেকে আসা শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘাত মেটানোর প্রচেষ্টা চালান এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। তার কাজ অসম্পূর্ণ থাকলেও তার স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে একটি বাজার স্থাপন করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় "কক্স সাহেবের বাজার।" এই বাজারই পরবর্তীতে কক্সবাজার নামে পরিচিত হয়।
১৮৫৪ সালে কক্সবাজার থানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৬৯ সালে এটি পৌরসভার মর্যাদা লাভ করে।

পর্যটন শিল্পের কারণে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান। এখানে রয়েছে বহু বেসরকারি হোটেল, পাঁচতারা হোটেল এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল। সৈকতের আশপাশে ঝিনুক মার্কেটসহ বিভিন্ন ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া সীমান্তপথে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং চীন থেকে আনা বাহারি পণ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে বার্মিজ মার্কেট।
কক্সবাজারে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতি বা নৃগোষ্ঠী শহরটির বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এইসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা প্রধান। শহর ও এর নিকটবর্তী রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। কক্সবাজারের এই মন্দিরগুলোতে দুর্লভ বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে, যা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।
শুধু সমুদ্র নয়, কক্সবাজারে রয়েছে বাঁকখালী নদী, যা শহরের মৎস্য শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে কক্সবাজার বাংলাদেশের অন্যতম স্বাস্থ্যকর এবং আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে পরিচিত।
সৈকতের অংশগুলো
লাবনী পয়েন্ট
বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত বলতে প্রথমেই যে নামটি মনে আসে, তা হলো পুরাতন সি-বিচ, যা লাবণী পয়েন্ট নামেও পরিচিত। সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাঙালিরা দলে দলে ছুটে যান কক্সবাজারের এই জনপ্রিয় সি-বিচে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারগামী বাসে কলাতলী সি-বিচ রোডে নেমে রিকশা অথবা পায়ে হেঁটে সহজেই পৌঁছানো যায় এই সৈকতে।

কক্সবাজার শহরের নিকটতম অবস্থানের কারণে লাবণী বিচকে প্রধান সমুদ্র সৈকত হিসেবে গণ্য করা হয়। সৈকতের সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে নানা আকর্ষণীয় দোকান, যেখানে পর্যটকদের জন্য সাজানো থাকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য। এখানে রয়েছে ঝিনুক মার্কেট, যা স্থানীয় এবং সীমান্তপথে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন থেকে আনা বাহারি জিনিসপত্রে সমৃদ্ধ। এই মার্কেটগুলো পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
কলাতলী পয়েন্ট
কলাতলী বিচ কক্সবাজারের আরেকটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যা শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসেন—কেউ সমুদ্রে গোসল করতে, কেউবা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
কলাতলী বিচে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের রেস্টুরেন্টসহ আরও অনেক পর্যটন সুবিধা, যা ভ্রমণকারীদের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। বিশেষ করে চাঁদনি রাতে এই বিচে হাঁটা সব বয়সী মানুষের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
কক্সবাজারগামী সকল যানবাহন শহরে প্রবেশের সময় কলাতলী পয়েন্ট অতিক্রম করে, যা এই বিচকে আরও সহজপ্রাপ্য এবং জনপ্রিয় করে তুলেছে।
সুগন্ধা পয়েন্ট

কলাতলী পয়েন্ট থেকে একটু দূরে উত্তর দিকে অবস্থিত সুগন্ধা পয়েন্ট, যা কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণ। এখানে জনপ্রিয় বার্মিজ মার্কেট অবস্থিত, যা পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়।
অতীতে সুগন্ধা পয়েন্টে অনেক সামুদ্রিক মাছের তৈরি খাবারের রেস্টুরেন্ট ছিল, তবে পরে সরকার সেগুলো উচ্ছেদ করে। বর্তমানে এই পয়েন্টের আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট, যা ভ্রমণকারীদের কাছে ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে।
দরিয়ানগর সৈকত
হিমছড়ি জাতীয় পার্কের কাছেই অবস্থিত দরিয়ানগর সৈকত, যা এর অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। এই সৈকতের মধ্য দিয়ে একটি জলপথ প্রবাহিত হয়েছে, যা দৃশ্যপটকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্যারাসেলিংয়ের জন্য দরিয়ানগর সৈকত বিশেষভাবে জনপ্রিয়, যা পর্যটকদের জন্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে।
হিমছড়ি
হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানের নিকটেই অবস্থিত দরিয়ানগর সৈকত, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মনোমুগ্ধকর স্থান। সৈকতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা জলধারা এর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তোলে। প্যারাসেলিংয়ের জন্য দরিয়ানগর সৈকত ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
ইনানী সৈকত
ইনানী সৈকত ১৮ কিলোমিটার (১১ মাইল) দীর্ঘ, যা কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত। এটি কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এই সৈকতে সবুজ ও কালো রঙের অনেক প্রবাল পাথর রয়েছে, যা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

টেকনাফ সৈকত
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত টেকনাফ সৈকত, যা কক্সবাজারের অন্যান্য সৈকত থেকে কিছুটা ভিন্ন। গাছগাছালিতে ঘেরা টেকনাফ ম্যানগ্রোভের তীরে অবস্থিত এই সৈকত। এটি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ভাগ হলো:
- শ্যামলাপুর সৈকত (বাহারছড়া সৈকত)
- শিলাখালী সৈকত
- হাজামপাড়া সৈকত
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের একটি অন্যতম সুন্দর এবং জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, দীর্ঘ সৈকত, পরিষ্কার পানির ঢেউ এবং নানান আকর্ষণ পর্যটকদের প্রতি বছর এখানে নিয়ে আসে। কক্সবাজার শুধু তার সমুদ্র সৈকতই নয়, এখানকার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা, দ্বীপ, নদী এবং মন্দিরগুলোও পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।
সৈকতের আশপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট এবং পর্যটন সুবিধাগুলি কক্সবাজারকে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চাঁদনি রাতে সৈকতে হাঁটা, প্যারাসেলিং, স্নরকেলিংসহ বিভিন্ন রোমাঞ্চকর কার্যকলাপ কক্সবাজারের অভিজ্ঞতাকে আরও স্মরণীয় করে তোলে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্ত পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিশ্রণে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিশ্বের অন্যতম বিউটিফুল স্পট হিসেবে পরিচিত।
Comments
Post a Comment