শীতকালীন সবজি ও ফলের অনেক গুণ
শীতকালীন সবজি ও ফলের অনেক গুণ
খাদ্যের উপাদান হিসেবে ভিটামিন এবং মিনারেলসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল শাক-সবজি ও ফলমূল। এগুলি মূলত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আমাদের শরীরের শর্করা, আমিষ ও চর্বি ব্যবহারে সহায়তা করে। অর্থাৎ, শরীরের সুরক্ষায় শাক-সবজি ও ফলমূলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বছরের প্রায় সব সময়েই শাক-সবজি ও ফলমূল পাওয়া যায়, তবে বাংলাদেশে ষড়ঋতুর মধ্যে শীতকাল হল শাক-সবজি ও ফলমূলের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। শীতকালে মৌসুমি শাক-সবজি ও ফলমূল গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের পুষ্টির চাহিদা, বিশেষ করে ভিটামিন ও মিনারেলসের চাহিদা সহজেই পূরণ করা যায়।
ভূমিকা
শীতকালীন শাক-সবজির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক এবং মানুষের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। শাক-সবজির আঁশ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান খাদ্যনালির ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শীতকালে বাজারে বেশি দেখা যায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, লালশাক, পালংশাক, মুলা, শালগম, শিম, টমেটো, পেঁয়াজ পাতা, লাউ, ব্রোকলি, মটরশুঁটি, গাজর, ধনিয়াপাতা ইত্যাদি। পুষ্টিবিদদের মতে, শীতকালীন শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফলিক এসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, আঁশ এবং ভিটামিন রয়েছে।
অস্থিক্ষয় রোধ এবং শরীরে রক্তকণিকা বা প্লাটিলেট গঠনে শীতকালীন শাক-সবজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-ই এর ঘাটতি পূরণের জন্য শীতকালীন শাক-সবজি বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত। শীতকালীন শাক-সবজিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন-ই রয়েছে, যা মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে রক্ষা করে এবং চুল পড়া রোধে সাহায্য করে।
ফুলকপি ও বাঁধাকপি শীতকালীন সবজির মধ্যে জনপ্রিয়। ফুলকপিতে রয়েছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসিড এবং পানি। এছাড়া আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং সালফারেরও ভালো পরিমাণ রয়েছে। ফুলকপিতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা কিডনির পাথর এবং ক্যান্সার নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে। ফুলকপিতে কোনো চর্বি নেই, ফলে এটি কোলেস্টরোলমুক্ত, যা শরীরের বৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য উপযোগী।
বাঁধাকপিতে রয়েছে ভিটামিন-সি এবং প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। এটি শরীরের হাড় শক্ত ও মজবুত রাখতে সাহায্য করে এবং ওজন কমাতে কার্যকর। এছাড়া বাঁধাকপি আলসার প্রতিরোধে সক্ষম।
শীতকালীন সবজির পুষ্টি গুণ
পুষ্টিগুণের দিক থেকে লালশাক ও পালংশাক অন্যান্য শাকগুলোর তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম লালশাকে প্রায় ৩৮০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে, এবং অন্যান্য পুষ্টিগুণও লালশাকে বেশি। পালংশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, আয়রন এবং ফলিক এসিড, যা আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত জরুরি। পালংশাক আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস, হৃদরোগ এবং কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শীতকালীন সবজি মটরশুঁটিতে প্রচুর ক্যালরি থাকে; প্রতি ১০০ গ্রামে ১২৫ কিলোক্যালরি পাওয়া যায়। শিম একটি উদ্ভিজ আমিষের বড় উৎস, যেখানে আমিষের পাশাপাশি স্নেহ ও ফাইবারজাতীয় উপাদানও থাকে। শিমের আঁশ পরিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। এটি রক্তে কোলেস্টরোলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে, পাকস্থলী ও প্লিহার শক্তি বাড়ায় এবং মেয়েদের লিউকোরিয়া ও অন্যান্য সমস্যা দূর করে। শিম শিশুদের অপুষ্টি দূর করে এবং পুষ্টি প্রদান করে।
রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে টমেটো, টমেটোজাত খাদ্য, পালংশাক এবং মিষ্টি আলু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্যালরিতে ভরপুর টমেটোতে প্রচুর ভিটামিন-সি রয়েছে, যা হাড় ও দাঁত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন-সি এর অভাবে হওয়া স্কার্ভি ও চর্মরোগ প্রতিরোধে টমেটো কার্যকর। টমেটোতে উপস্থিত লাইকোপেন ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, যার কারণে এটি Intestinal antiseptic হিসেবে পরিচিত। এছাড়া টমেটোতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রকৃতির আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির বিরুদ্ধে কাজ করে।
গাজর
গাজর স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি চোখ ও দাঁতের সুরক্ষায়, লিভার সুস্থ রাখতে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। গাজরে রয়েছে বিটা-ক্যারোটিন, থায়ামিন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-কে, ফাইবার, ম্যাংগানিজ এবং পটাশিয়াম।
গাজরের বিটা-ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং এতে উপস্থিত ক্যারোটিনয়েড ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। বেশি গাজর খেলে পেট ভরবে, কিন্তু অতিরিক্ত ক্যালোরি যোগ হবে না, তাই এটি শরীরের ওজন কমাতে এবং সুস্থ ত্বক পেতে সাহায্য করে।
ব্রোকলি
ব্রোকলি, যা আমাদের দেশের শীতকালীন একটি নতুন সবজি, দেখতে সবুজ ফুলকপির মতো। এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ব্রোকলি চোখের রোগ, অস্থিবিকৃতি এবং অন্যান্য উপসর্গ দূর করতে সাহায্য করে, পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও কার্যকর।
ধনিয়া পাতা
ধনিয়াপাতা এখন সারা বছর পাওয়া গেলেও এটি মূলত শীতকালীন সবজি। ধনিয়াপাতা সরাসরি সালাদ হিসেবে অথবা রান্না করে খাওয়া যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-কে এবং ফলিক এসিড রয়েছে, যা আমাদের ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ধনিয়াপাতার ভিটামিনগুলো ত্বকের পুষ্টি জোগায়, চুলের ক্ষয় রোধ করে, হাড়ের ভঙ্গুরতা কমায় এবং মুখের নরম অংশগুলো রক্ষা করে।
শীতকালীন ফলমূল
ফল হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং মিনারেলসের সহজ ও সস্তা উৎস। ফল রান্না ছাড়াই খাওয়া যায়, যার ফলে এর পুষ্টিগুণ অবিকৃতভাবে আমাদের দেহে প্রবাহিত হয়, যা বিভিন্ন রোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে। ফলের মধ্যে উপস্থিত মিনারেলস যেমন ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস দেহের বিপাকীয় কার্যাবলি স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া ফল শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, পানি সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান দেহে সরবরাহ করে, যা আমাদের সুস্থ রাখে।
শীতকালে বাজারে পাওয়া যায় বিভিন্ন জাতের কুল বা বরই, কমলালেবু, জলপাই, আমলকি, আপেল, সফেদা, ডালিম ইত্যাদি। শীতকালে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফলগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে নানা জাতের কুল বা বরই, যেমন নারকেলি কুল, আপেল কুল, বাউকুল ইত্যাদি। এই ফলটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং শীতকালীন উপকারী ফল।
কমলালেবু
কমলালেবুতে রয়েছে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ফাইবার ও মিনারেলস, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে পরিচিত।
জলপাই
শীতকালীন ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল হিসেবে জলপাই খুবই উপকারী। জলপাই উচ্চ রক্তচাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পাকস্থলীর কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর। এতে রয়েছে ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-ই, যা দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয়।
আমলকি
শীতকালীন ফল আমলকি ভিটামিন-সি’র রাজা হিসেবে পরিচিত। এটি ত্বক সুরক্ষা, মাড়ি মজবুত করতে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আপেল
সারা বছর পাওয়া গেলেও শীতকালে বেশি পাওয়া যায় পুষ্টিকর ফল আপেল, যা প্রচুর আঁশ ধারণ করে। এতে রয়েছে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি1, ভিটামিন-বি12, ভিটামিন-বি6 এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। আপেল কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর।
সফেদা
শীতকালীন আরেকটি ফল সফেদা, যা আমাদের দেশে একসময় কম পরিচিত ছিল, কিন্তু এখন এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সফেদা ক্যান্সার প্রতিরোধক, কোষ্ঠকাঠিন্য দূরকারী, কিডনি সুরক্ষা এবং সতেজ ত্বকের জন্য উপকারী। এতে রয়েছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, পটাশিয়াম, কপার, আয়রন এবং ফাইবার।
বেদানা
শীতকালীন আকর্ষণীয় এবং রসালো ফলের মধ্যে বেদানা বা আনার অন্যতম। এতে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন-সি রয়েছে, যা কুষ্ঠরোগ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হার্ট সুস্থ রাখতে সহায়ক।
উপসংহার
শীতকালীন সবজি ও ফল আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এগুলোর মধ্যে উপস্থিত ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। শীতকালীন সবজি যেমন পালংশাক, ব্রোকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং ফল যেমন কমলালেবু, আমলকি, জলপাই, আপেল, সফেদা, বেদানা আমাদের শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সহায়ক এবং সুস্থ জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য।
এই সবজি ও ফলগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ক্যান্সার, হৃদরোগ, অস্থিক্ষয়, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এগুলো ত্বক এবং চুলের সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়তা করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং শরীরের বাড়তি ক্যালরি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
অতএব, শীতকালীন এই সবজি ও ফল খেয়ে আমরা আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সহজে অর্জন করতে পারি এবং দীর্ঘকাল সুস্থ ও সবল জীবনযাপন করতে পারি।
Comments
Post a Comment