বাঙালির লোকজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পিঠাপুলি এক
গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পিঠা-পায়েস শীতকালের রসনাসম্মত
খাবার এবং বাঙালি সমাজে এটি বিশেষভাবে সমাদৃত।
আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে এবং
বন্ধন মজবুত করতে পিঠার উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে শীতকালে পিঠা তৈরির
ধুম পড়ে। কুয়াশামাখা সকাল কিংবা সন্ধ্যায়
গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত
থাকেন। অতিথি, বিশেষ করে জামাইদের দাওয়াত করে
পিঠা খাওয়ানো এ সময়ের বিশেষ রীতি। খেজুরের রস
থেকে তৈরি গুড়, পায়েস এবং অন্যান্য মিষ্টান্ন
পিঠার স্বাদ আরও বাড়িয়ে তোলে।
শীতকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হলো ভাপা পিঠা।
এর পাশাপাশি চিতই পিঠা, দুধচিতই, পাটিসাপটা,
তিলকুলি, মালপোয়া, নকশি পিঠা প্রভৃতি বহু
প্রকারের পিঠা তৈরি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন
অঞ্চলে প্রায় শতাধিক ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে।
কিছু পিঠা হারিয়ে গেলেও এ ঐতিহ্য পুরোপুরি
বিলুপ্ত হয়নি। এখন শহর এলাকায়ও শীতের পিঠার
সুবাস পাওয়া যায়।
শীত এলে শহরের বিভিন্ন ফুটপাতে, জনবহুল এলাকায়
এবং টার্মিনালগুলোতে পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে। ভাপা
পিঠার পাশাপাশি চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, মালপোয়া
ইত্যাদি বিক্রি হয়। যদিও এগুলো অনেক সময়
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয়, তবু শীতকালে পিঠা
বিক্রির ব্যবসা বেশ জমজমাট।
একসময় সোনার বাংলায় যেমন শত শত প্রজাতির ধান
ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও ছিল নানা বৈচিত্র্য।
পিঠা তৈরি ছিল বাংলার নারীদের ঐতিহ্য। পিঠাকে
কেন্দ্র করে অনেক গান, কবিতা ও ছড়া রচিত হয়েছে।
বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল পিঠাকে ঘিরে
লিখেছেন,
"পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/
আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি
পেয়ে।"
পিঠাপুলি বাঙালির লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই
বহিঃপ্রকাশ। হাজারো সমস্যার মধ্যেও গ্রামবাংলার এই
পিঠা-পার্বণের আনন্দ-উৎসব মুছে যায়নি। এই ঐতিহ্য
যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে টিকে থাকুক।
শীতকালীন বাঙালির সংস্কৃতি
বাঙালির লোকজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পিঠা-পুলির ভূমিকা
প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গ্রামের গৃহিণীরা
পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটান। হরেক রকমের
মুখরোচক পিঠা-পায়েস তৈরি করে নতুন জামাই কিংবা
অতিথিদের আদর-আপ্যায়নে মেতে ওঠেন গ্রামের
মায়েরা।
এক সময় গ্রামে-গঞ্জে নতুন বউদের শ্বশুরবাড়িতে
পাঠানো হতো রঙিন হাঁড়ি বা বড় ডালাভর্তি ফুলপিঠা,
পাক্কন পিঠা, সঙ্গে থাকত গুড়, মুড়ি, চিঁড়ে,
পান-সুপারি। তবে কালের বিবর্তনে এ সংস্কৃতি
অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবু এখনো শীতকাল
বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান আর সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে
ভরপুর। এই সময়ে মানুষের আর্থিক অবস্থা অনেকটাই
ভালো থাকায় বিয়ে-শাদি, সুন্নতে খৎনা, গায়ে হলুদ,
মুখেভাত, অতিথি আপ্যায়নের মতো বড় আয়োজন হয়।
এসব অনুষ্ঠানে পিঠা-পুলির বিশেষ ব্যবহারের ঐতিহ্য
এখনো টিকে আছে।
আমাদের দেশে আত্মীয়স্বজন ও পারস্পরিক সম্পর্কের
বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে মুখরোচক, রসসমৃদ্ধ
পিঠা-পুলির উৎসব এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এটি
শুধু বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ নয়, বরং এক গভীর
সামাজিক সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ।
শীতকালীন পিঠার ঐতিহ্য
প্রত্যেক দেশেরই কিছু ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন থাকে,
যা তাদের খাদ্যসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই পরিচয় বহন করে পিঠা।
পিঠা কেবলমাত্র একটি লোকজ খাবার নয়; এটি বাঙালির
স্মৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অমূল্য ভাণ্ডার।
প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসেবে পিঠার
জনপ্রিয়তা ছিল সর্বোচ্চ।
আমাদের দেশে শীতকাল মানেই পিঠা-পুলির উৎসব। শীতের
সকাল বা সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা গরম পিঠা,
ক্ষীর-পায়েস খাওয়ার রেওয়াজ বাঙালির আবহমান
সংস্কৃতিরই অংশ। যদিও পিঠা-পুলির উৎপত্তি গ্রামীণ
বাংলায়, এটি বাঙালির শেকড়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে
জড়িত।
এক সময় শহরের মানুষ শুধুমাত্র শীতের পিঠার স্বাদ
নিতে গ্রামে ছুটে যেত। পরিবার-পরিজন মিলে পিঠা
খাওয়ার সেই উৎসব এক সময় খুব সাধারণ ছিল। তবে
সময়ের পরিবর্তনে সেই ঐতিহ্য ও রীতি অনেকটাই ফিকে
হয়ে গেছে। তবু, পিঠা আজও বাঙালির শীতকালীন
খাদ্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শীতকালীন পিঠা কত প্রকার ও কী
কী
বাংলাদেশে পিঠার রয়েছে বিপুল বৈচিত্র্য এবং
অঞ্চলভেদে নানা স্বাদ ও রূপ। কিছু পিঠা সারা দেশেই
জনপ্রিয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভাপা পিঠা,
চিতই পিঠা, ঝাল পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিট পিঠা, দুধ
চিতই, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, সেদ্ধ
পুলি, নারকেল জেলাপি, বিবিখানা, চুটকি, চাপড়ি,
ক্ষীর কুলি, গোকুল, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা,
রসফুল, জামদানি, ঝালপোয়া, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা,
সূর্যমুখী, নকশি পিঠা, চাঁদ পাকান, সুন্দরী পাকান,
সরভাজা, পাটিসাপটা, পানতোয়া, মালপোয়া, মালাই
পিঠা, মুঠি পিঠা, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা
পিঠা, খেজুর পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা,
তেলপোয়া, দুধরাজ, ফুলঝুরি, সেমাই পিঠা
ইত্যাদি।
সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠাগুলোর মধ্যে ভাপা পিঠা ও
চিতই পিঠার নাম প্রথমে আসে। কালের বিবর্তনে কিছু
পিঠা হারিয়ে গেলেও অনেক পিঠা এখনও টিকে আছে।
শীতকাল এলেই গ্রামাঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত পিঠার
আয়োজন শুরু হয়।
পিঠা তৈরির প্রধান উপাদান হলো চালের গুঁড়া,
ময়দা, খেজুর গুড় বা চিনি, নারকেল এবং তেল। তবে
কিছু পিঠায় ভিন্ন স্বাদের জন্য মাংস ও সবজিও
ব্যবহার করা হয়। পিঠার এই ঐতিহ্য বাঙালির
খাদ্যসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শীতকালীন বাংলাদেশের কিছু জনপ্রিয়
পিঠা
ভাপা পিঠা
বাংলাদেশে জনপ্রিয় একটি পিঠা হলো ভাপা পিঠা, যা
কোথাও ধুপি পিঠা বা ধুকি পিঠা হিসেবেও পরিচিত।
বাষ্পে সিদ্ধ করা হয় বলে এর নাম ভাপা পিঠা। এই
পিঠার মধ্যে খেজুরের রসের নতুন গুড় ও নারিকেল
থাকে, এবং এটি চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ছোট ছোট
পিঠার মধ্যে পরিবেশন করা হয়।
নকশি পিঠা
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বড় একটি উদাহরণ
হলো নকশি পিঠা। বিশেষ করে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে
পাক্কান পিঠা এবং ফুল পিঠা তৈরি হয়। চালের খামির
দিয়ে মোটা করে বেলা হয়, তারপর তার উপরে খেজুর
কাঁটা দিয়ে গভীরভাবে আলপনা আঁকা হয়। এগুলিকে ফুল
নকশি পিঠা, পাক্কান পিঠা বা সুঁই কাটা মুগপাক্কন
পিঠা বলা হয়।
চিতই পিঠা
চিতই পিঠা বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের মধ্যে পরিচিত
এবং জনপ্রিয়। শহরের অলিগলিতেও এই পিঠা পাওয়া যায়।
চিতই পিঠা সাধারণত খেজুর গুড় ও নারিকেলের পুর দিয়ে
তৈরি করা হয় এবং দুধে ভিজিয়ে খাওয়া হয়।
পাটিসাপটা পিঠা
পাটিসাপটা পিঠা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পিঠা।
চালের গুঁড়ো ও খেজুর গুড়ের মোলায়েম আবরণের ভেতরে
ঘন দুধে তৈরি পায়েস বা নারকেল দিয়ে তৈরি হয়
পাটিসাপটা পিঠা। এলাকার ভেদে পাটিসাপটা পিঠার
পরিবেশন ভিন্ন হতে পারে, তবে সব ক্ষেত্রেই এটি
সুস্বাদু হয়।
পুলি পিঠা
পুলি পিঠা বিভিন্ন উপায়ে তৈরি করা যায়, তবে
ঐতিহ্যবাহী পুলি পিঠা গুড় ও নারিকেলের পুর দিয়ে
তৈরি করা হয়। দুধ পুলিকে দুধে ভিজিয়ে রাখা হয় এবং
মশলা, খেজুর গুড় ও নারকেল দিয়ে স্বাদ বৃদ্ধি করা
হয়। পুরে ভরা পুলি পিঠা সাধারণত তেলে ভাজা
হয়।
অঞ্চল ভেদে কিছু দেশীয় পিঠা
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী
পিঠার প্রচলন রয়েছে। অঞ্চলভেদে কিছু পিঠার নাম
ভিন্ন হতে পারে। ঢাকা অঞ্চলের কিছু ঐতিহ্যবাহী
পিঠার মধ্যে গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছানার মালপোয়া,
বিবিখানা পিঠা, কলা পিঠা, মুখশলা পিঠা, চাপড়ি
পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের
ঝাল পুয়া, তিল পুলি, সাবুর পিঠা অন্যতম। নোয়াখালী
ও কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে ডিমের
পানতোয়া, খোলাজা পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা,
নারিকেলের চিড়া রয়েছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী
কিছু পিঠা হল আতিক্কা পিঠা, বিন্নি পুলি, বিবিখানা
পিঠা। সিলেটের গ্রামাঞ্চলে চুঙ্গাপুড়া পিঠা, নোনতা
বা নুনগড়া পিঠা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। খুলনা ও
বাগেরহাট অঞ্চলের প্রিয় পিঠা হল হাতে বানানো হাত
সেমাই পিঠা।
উপসংহার
পিঠা তৈরি আবহমান বাংলার মা-মেয়েদের ঐতিহ্যের একটি
অংশ। এক সময় আমাদের দেশে ছিল শত শত নামের ধান, আর
তখনকার মতো নানা রকম পিঠারও প্রচলন ছিল।
পিঠা-পুলিকে কেন্দ্র করে অনেক গান, কবিতা রচিত
হয়েছে, যা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন। এত বিচিত্র রকমের পিঠা
সম্ভবত আর কোনো দেশে তৈরি হয় না। হাজারো বাধা ও
সমস্যা সত্ত্বেও গ্রামবাংলার মা, বোন, চাচি,
খালাদের পৌষ পার্বণে পিঠা বানানোর উদ্দীপনা আজও
জীবিত। শীতকালে নবান্নের সময় পিঠা বানানোর এই
আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে বেঁচে
থাকুক।
Comments
Post a Comment